Home সুমন নামা অসময়ের কোভিড (২)

অসময়ের কোভিড (২)

সুমন চট্টোপাধ‍্যায়

by developer developer
0 comments

কোভিড সন্দেহ করা রুগি আগেভাগে জানিয়ে গেলে হাসপাতালের এমার্জেন্সি ওয়ার্ডেও সম্ভবত ভিআইপি-র মর্যাদা পায়, অন্তত আমিতো তাই পেলাম। গাড়ি থামামাত্র দেখি হুইল চেয়ার নিয়ে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে অপেক্ষমান। এই যন্তরটিকে আমি অন্তর থেকে অপছন্দ করি, আগে যেমন মানুষের হাতে টানা রিকশ গাড়িকে করতাম। হুইল চেয়ারে বসলে আমার পৌরুষ, আত্মবিশ্বাস, অহংবোধ সব কিছু একই সঙ্গে আঘাত-প্রাপ্ত হয়, নিজেকে মনে হয় একটি আই এস ও সার্টিফায়েড ক‍্যালানে মদন। আমি গতর ডুবিয়ে বসে থাকব আর অন‍্য একজন পিছন থেকে ঠেলা মারতে মারতে নিয়ে যাবে, এমন একটি দৃশ‍্যকল্প রানীমার ছবি বা অবোধের কবিতার মতোই আমার পুরোদস্তুর জঘন‍্য মনে হয়।

চারপাশের হাড়ে-হাভাতে হতচ্ছাড়ার দল এমনভাবে হুইল চেয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন মনে হয় চিড়িয়াখানায় নতুন আসা কোনও ওরাং-ওটাংকে অবলোকন করছে। সেই মরা মাছের দৃষ্টিতে মায়া, মমতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতার ছিটেফোঁটাও থাকেনা, থাকে দিনভর লগি ঠেলা, কোষ্ঠ-কাঠিন‍্যে ভোগা, জীবন সংগ্রামে ব‍্যর্থ বাঙালি বাবু-বিবিদের ঈষৎ ঈর্ষা মাখা নিরাসক্তি। আমি কদাচ কারও অনুকম্পার পাত্র হতে চাইনা, মনের বয়সটাকে গত অর্ধ-শতক ধরে প্রাণপনে ষোলোর ওপরে উঠতেই দিইনি। সেই আমি কিনা চড়ব হুইল চেয়ারে?

হাসপাতালের কর্মীটি নাছোড়, এটাই নাকি হাসপাতালের স্বীকৃত প্রোটোকল, ওয়ার্ল্ড রেসলিংয়ের রিং থেকে ছিটকে হঠাৎ যদি জন সিনা উদয় হয় তাকেও বসতে হবে হুইল চেয়ারে। স্বভাব স্বেচ্ছাচারী হলেও আমি নিয়মের সঙ্গে কুস্তি করায় বিশ্বাস করিনা, যস্মিন দেশে যদাচারের নীতি মেনে চলার চেষ্টা করি যথাসম্ভব। বলতে পারেন সেই অর্থে আমি কনস্টিটিউশনাল অ‍্যানার্কিস্ট। সোনার পাথরবাটির মতো শোনাচ্ছে? শোনাক, আমি নিরুপায়।

দরজা খুলেই হুইল চেয়ার প্রচন্ড গতিতে চলতে শুরু করল। এক্কেবারে সুরজিৎ সেনগুপ্তর স্টাইলে, কখনও বাঁদিকে ডজ মারছে তো কখনও ডানে, সারি সারি বিছানার মাঝের আলপথ দিয়ে এমন কায়দা করে জায়গা করে নিচ্ছে যে এক ঝলকের জন‍্য মনে পড়ে গেল মারাদোনাকেও। বন্দে ভারত শেষ পর্যন্ত হলঘরের একেবারে শেষ প্রান্তে এক চিলতে একটি মলিন ঘরের সামনে এসে থামার পরে বোধগম‍্য হোল ঢপের প্রোটোকলের গূঢ, গোপন, কারণটি আসলে কী! প্রশস্ত এমার্জেন্সিতে ওটাই অচ্ছুতদের জন‍্য বরাদ্দ, যার কেতাবী গালভরা নাম ‘আইসোলেশন রুম।’ কোভিড কেস এলে রুগিকে যত দ্রুত সম্ভব সেখানে গ‍্যারেজ করে দাও, অন‍্যের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে। ফলে রুগি এলে তাকে ছাড়া গরুর মতো এখানে সেখানে পায়চারি করতে দেওয়া যায়না, বলি প্রদত্ত পাঁঠার মতো হুইল চেয়ারে চাপিয়ে তাকে হুশ করে ওই চোরা কুঠুরির বিছানায় নামিয়ে দাও। হাসপাতালের নিজস্ব শব্দকোষে ইহাকেই বলে ‘প্রোটোকল।’কেসটা আসলে জাঙ্গিয়ার বুক পকেট বই কিস‍্যু নয়। আমার শরীরে গত কয়েকদিন যাবৎ নানা তুঘলকি কান্ডকারখানা ঘটে চলেছে ঠিক, কিন্তু কোভিডই হয়েছে সেই সত‍্য বা মিথ‍্যাটুকুতো পরীক্ষার মাধ‍্যমে এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তাহলে স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে আমাকে দীপান্তরে পাঠানো হোল কেন। হঠাৎ বঙ্কিমবাবুকে মনে পড়ল। অপরাধী জানিযতে পারিলনা কী তার অপরাধ অথচ বিচার হইয়া গেল।

হুকোমুখো টাইপের এক শীর্ণকায় বিহারী সেই ঘরে আমার প্রথম ভিজিটর। হাতে হাসপাতালে থাকার দুই খন্ড পোশাক। এতক্ষণ লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে নীরবে সব সহ‍্য করেছি, ওই পোশাক দেখেই মটকা গরম হয়ে গেল। এমনিতেই হাসপাতালে ভর্তি থাকা রুগীদের ইউনিফর্মের সঙ্গে বৃন্দাবনের অসহায় বিধবার পরনের মলিন শাড়ির পার্থক‍্য বোঝা যায়না, আমার বিষয়টি বিদ্ঘুটে লাগে। হাসপাতাল হোল আমার চোখে চিতার সামনে লাইন দিয়ে সাজানো কয়েকটি দেহ, শ্মশানে সেগুলি নাড়াচাড়া করেনা, এখানে করে। মৌলিক পার্থক‍্য বলতে গেলে এইটুকুই।

বল হরি হরি বোল হয়ে যাওয়ার পরেও মানুষ কেমন পরম মমতায় নিথর লাশকে সাজায়, কপালে শ্বেত-চন্দনের তিলক কাটে, আলমারি থেকে হয় আনকোরা নতুন কাপড় নতুবা কিপটে হলে ধোপাবাড়ি ফেরত পাটভাঙা বস্ত্র পরিয়ে দেয় শেষ পর্যন্ত তা ডোমের বৌয়ের হস্তগত হবে জেনেও। অথচ হাসপাতালে বন্দী যাঁরা, তাঁদের মধ‍্যে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের ললাটে হয়ত রাম নাম সত‍্য হ‍্যায় লেখা আছে, বাকিদেরতো নেই! বাকিরা সবাই সন্ধ্যার বনস্পতির কোলে কিচির মিচির করে ফেরত আসা পাখীদের মতো বাড়িতেই ফিরবে, হাসপাতালের ব‍্যবসার খাতার বটম লাইন স্ফীতকায় হবেতো এদেরই জন‍্য, তা দিয়ে কসাইখানার ঔজ্জ্বল‍্য আরও বাড়বে, নতুন নতুন অ্যানেক্স বিল্ডিং তৈরি হবে, গলা কাটার আরও নতুন নতুন সব দানবীয় যন্ত্র বসবে, হবে আরও কত কী!

হাসপাতালের আসল মা লক্ষ্মী যাঁরা যত অলুক্ষুনে সিদ্ধান্ত সব তাঁদেরই জন‍্য। ডায়েট চার্টে তিন বেলা এমন সব অখাদ‍্য পরিবেশন কর যা গোয়াল হারানো গরু পর্যন্ত স্পর্শ করতে অস্বীকার করবে। এমন ম‍্যারমেরে এলোঝেলো ইউনিফর্ম পরাও যাতে তাকে সার্কাসের ভাঁড় থেকে বহরমপুর জেলের বনেদি কয়েদি প্রথম দর্শনে যা চাইবেন সেটাই মনে হতে পারে। আমার মুশকিল হয় নেয়াপাতি ভুঁডিটাকে নিয়ে, খাটো পায়জামার দড়ি যত শক্ত করেই গিন্নি বেঁধে দিননা কেন, কিছুক্ষণ পরেই স্নেহের মতো তা নিম্নগামী হতে শুরু করে। প্রথম প্রথম লজ্জা হোত, এখন পুরোপুরি নির্লজ্জ হয়ে গিয়েছি। বাচ্চা বাচ্চা যে মেয়েগুলো নার্সের কাজ করে তারা আমার নাতনির বয়সী, ওদের কাছে আমার কোনও লজ্জাবোধ থাকেনা। তাছাড়া দ্রষ্টব‍্য বলতে কিছুই যখন আর অবশিষ্ট নেই তখন নাগা সন্ন‍্যাসী হয়ে থাকলেই বা কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়!

ওই বেহারি পাঁচুর হাতে সেই ইউনিফর্ম দেখে আমার বিস্তর রাগ হোল।

ইয়ে কাপড়া কিঁউ?

আপকে লিয়ে। অ‍্যাডমিশন সে পহলে ইয়ে পহেনা হোতা হ‍্যায়!

আপকো ক‍্যায়সে পাতা মেরা ভর্তি হোনেওয়ালা হ‍্যায়?

নেহি আর এম ও সাহাব নে বোলা।

কৌন হ‍্যায় আপকা আর এম ও? উনকো ভেজিয়ে।

আমার বাজখাঁই গলা শুনে সে বেচারা তাড়া খাওয়া মূষিক শাবকের মতো ভাগলবা!

অতঃপর আর এম ও এসে আমাকে বল করার কোনও সুযোগ না দিয়েই খোশ গপ্পো জুড়ে দিলেন। উত্তর কলকাতার শিল বাড়ির ছেলে, বসত ভিটের বয়সের গাছ পাথর নেই, সেই জীর্ণ দালান রক্ষা করাই এখন সমূহ সমস‍্যা। বললেন, কোম্পানি আমলে তাঁদের নাকি নিজস্ব পারিবারিক কয়লাখনি পর্যন্ত ছিল, এখন শুধুই দীর্ঘশ্বাস। সখেদে জানালেন পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে অচিরেই তিনি স্ত্রী আর এগারো বছরের কন‍্যাকে নিয়ে শহরের অন‍্যত্র কোথাও ফ্ল‍্যাট কিনে উঠে যাবেন। ইতিহাসের সামান‍্য ছাত্র আমি, নিজে ছিন্নমূল বাঙাল তবু পুরোনো কলকাতার নস্টালজিয়ায় অবগাহন করতে দিব‍্যি লাগে। ডাক্তারের শেষ সংলাপটি বুকে শেলবিদ্ধ করল।

দুই বিঘা জমি পড়েছেন?

ছেলেবেলায়। কিন্তু কেন বলুনতো!

সপ্ত-পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া/ দৈন‍্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে, এমনি লক্ষ্মীছাড়া?

এবার ডাক্তারের পার্টিং কিক।

যে তল্লাট থেকে বাঙালি তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফেলেছে, পাড়াটাকে পুরোনো জয়পুরের এক খন্ড জনপদের মতো দেখায় সেখানে একা আমি ভূষুন্ডির কাক হয়ে থাকি কী করে বলুন?

আমার মতো ফরফরিদাসের কাছেও কোনও জবাব ছিলনা। সত‍্যিতো, গোটা কলকাতাটাই তো আজ বাঙালির বেহাত হয়ে গেল।

আর কথা না বাড়িয়ে এবার পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলো সেরে ফেলার অনুরোধ করলাম। আবার দেখি সেই হুচুম্ফু এসে হাজির। যে দ্রুততা আর দক্ষতার সঙ্গে সে রক্ত টানল, হাতে চ‍্যানেল তৈরি করল, এক্স রে -সিটি স্ক‍্যান করিয়ে আনল তা দেখে আমি সত‍্যিই অভিভূত। একবার ভাবলাম বলেই ফেলি, ‘ভাইয়া বিহারকা কিসি মেডিকেল কলেজ সে আপ এক এমবিবিএস ডিগ্রি লে আও।’

আগের রাতে ঘুম হয়নি, তারপর সকালে হাসপাতালের ধকল। পরীক্ষা পর্ব উত্তীর্ণ হওয়ার পরে এত ক্লান্ত বোধ হচ্ছিল, ওই কালাপানি পার করে পৌঁছন সেই অচ্ছুতদের ঘরের এক ফালি বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই চোখ-জোড়া বন্ধ হয়ে গেল।

তখনও জানিনা আমি কোভিড পজিটিভ না নই। ফলে নিজের জেদে আমি তখনও অবিচল। মলিন অহংকার নিয়ে বাড়ির মলিন বসনই আমার গায়ে। (চলবে)

You may also like

Leave a Comment

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles

All Right Reserved.