‘সেটিং’।
অস্বীকার করার উপায় নেই কেষ্ট মন্ডলের ভাষা, তাঁর ব্যবহৃত শব্দকোষই এখন ‘এগিয়ে বাংলার’ রাজনীতি অথবা সামাজিক মাধ্যমে কথোপকথনের মূল-ধরায় পর্যবসিত হয়েছে। সত্যি কথা বলতে, এ বিষয় নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কোনও নৈতিক অবস্থান নেই যদিও এমনটি কেন হোল আমি তা বিলক্ষণ বুঝি! এ সবই লুম্পেনতন্ত্রের শিকড় গজানোর আবশ্যিক, অনিবার্য অনুষঙ্গ।
খিস্তি-খেউড় আমরাও ভালো জানি, কলেজ জীবনে খিস্তিকে কীভাবে বুদ্ধিদীপ্ত, আধুনিক, প্রাণবন্ত করে তোলা যায় তা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছি। তবু প্রকাশ্যে, হাটে-বাজারে, বাসে-ট্রামে, পাড়ার চায়ের ঠেকে, বারদুয়ারির বেঞ্চে বসেও সেই অনুশীলিত বিদ্যা প্রকাশ্যে জাহির করতে বাধো বাধো ঠেকেছে, শত প্ররোচণাতেও ‘মনের কথাটি নীরব মনে’ লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছি। শিক্ষিত, কিছুটা আলোকিত, মধ্যবিত্তের নীতিবোধই বারে বারে অলঙ্ঘ চিনের প্রাচীর হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
লুম্পেনতন্ত্রে আব্রু মূল্যহীন, উন্নতির পথে কখনও-সখনও মস্ত প্রতিবন্ধকও বটে।ফলত কিছুকাল আগেও যা ছিল ‘অ্যাব-নরম্যাল’ এখন সেটাই জবরদস্ত ‘নিও নর্মাল’ হয়েছে, এই যা। লুম্পেনতন্ত্রকে বাইরে থেকে এলোঝেলো দেখায়। কিন্তু তারও নিজস্ব নিয়মনীতি, পছন্দ-অপছন্দ, অনুশাসন, সবই আছে। মাফিয়া আন্ডার ওয়ার্লেডের নিজস্ব ‘কোড’ থাকার মতো।যেমন ধরুন কয়েকটি বাংলা শব্দ লুম্পেনতন্ত্রে পুরোপুরি নিষিদ্ধ- বই, খাতা, শিক্ষা, রুচি, সততা, নীতি, সুনীতি, নীতিবোধ, লজ্জা, ভয় ইত্যাদি। সময় নিয়ে ভাবতে বসলে আরও অজস্র শব্দ হয়তো মাথায় আসবে, সে চক্করে আমি আপাতত প্রবেশ করছিনা। ধান ভানতে শিবের গীত অনেক হোল, অতিরিক্ত একটি শব্দও নিষ্প্রয়োজন। ছিলাম হাসপাতালে, কেষ্টর দৌরাত্ম্যে চলে গেলাম কঙ্কালিতলায়।
ইংরেজিতে ‘সেটিং’ শব্দের অর্থ কী আমরা সবাই জানি। যে অর্থে শব্দটি হালফিলে ব্যবহৃত হয় তার সঙ্গে আভিধানিক অর্থের কোনও সম্পর্কই নেই। বেশ কিছুকাল আগে দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক পুজো কমিটি ওয়ার্লড ট্রেড সেন্টারের সমান উচ্চতায় মায়ের মূর্তি গড়ার আহ্লাদ দেখিয়েছিল, মনে পড়ে? ওই পুজোর স্পনসর ছিল একটি বড় সিমেন্ট কোম্পানি। পুজোর মাস খানেক আগে থেকে সেই কোম্পানি গোটা শহর জুড়ে হোর্ডিং লাগিয়েছিল একটি ‘টিজার’ বিজ্ঞাপনের লাইন লিখে।
‘আমার সেটিং হয়ে গিয়েছে। আপনার?’
ব্যস, মহাপ্রলয় সেই যে শুরু হোল এখনও তা সমান তেজে বঙ্গ-মন তোলপাড় করে রেখেছে। গুগল করলে হয়ত দেখা যাবে বাংলা বইয়ের বেস্ট সেলারের তালিকায় ফেলুদা যেমন পয়লা নম্বরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে বসে আছেন, অনেকটা তেমনভাবেই বাংলায় জনতার সারণিতে জনপ্রিয়তম শব্দের আসন দখল করে বসে আছে ‘সেটিং’। স্বভাবে ষড়যন্ত্রী বাঙালি দেব-দ্বিজ-কুষ্টি-পাথরের চেয়েও ষড়যন্ত্রের তত্ত্বে বেশি বিশ্বাস করে, কোথাও কিছু বেচাল দেখলেই সে ধরে নেয় নিশ্চিত সেটিং হয়ে গিয়েছে। দিদির সঙ্গে মোদির, অধীরের সঙ্গে বিজেপির, কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের, ফুরফুরা শরিফের সঙ্গে তৃণমূলের, শাহবাজ শরিফের সঙ্গে ট্রাম্পের, চাইলে সাপের সঙ্গে কুনো ব্যাঙের। হয়না কেবল সুবুদ্ধি আর বাস্তবের সেটিং। মরুক গে যাক, এই মুশল পর্বে ‘চলেগা’ সব কিছুই।
আমার হান্টারওয়ালি ডাক্তার মৌসুমী দিদিমনিকে আমি অস্ফুটভাবে একটিবারই কেবল নিজের সেটিংয়ের কথা বলেছিলাম। কার সঙ্গে সেটিং, কী নিয়ে সেটিং, তার ফলে কীভাবে আমার এক লহমায় মরার ভয় কেটে গেল, এ সব নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্যই করিনি। করতে যাবইবা কেন? একে তো কসাইখানায় জলের মতো মাল গলে যাচ্ছে, কখনও বলছে কোভিড হয়নি, কখনও বলছে হয়েছে, কখনও আবার বলছে আমার ধমনীর রক্ত নাকি ল্যাবরেটরিতে পাঠানোই হয়নি, কখনও বলছে ভুল ভাবে পাঠানো হয়ে গিয়েছে।
এমন বিচ্ছিরি, অদ্ভুতুড়ে পরিস্থিতির মধ্যে দ্বিতীয় রাত দ্বিপ্রহরে আমাকে দশ তলার ঘর থেকে নয় তলায় আইসোলেশন ওয়ার্ডে চালান করা হোল অত্যন্ত অপমানজনকভাবেই। আই পি এলের ফাইনাল ম্যাচ তখন মাঝপথে, সোজা হয়ে বসে খেলা দেখছি, মনেপ্রাণে চাইছি নীতা আম্বানির সাদা ফ্যাকাশে মুখটা যেন খেলা শেষে আষাঢ়ের প্রথম দিবসের মেঘের রঙে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। হোলনা, আমাকে চলে যেতেই হোল, পাঞ্জাবও গেল হেরে। পরের দিন সকালে মৌসুমী আমার অকারণ হেনস্থার জন্য হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেন, আমিও মহতের ধর্ম পালন করলাম বিনা বাক্যব্যয়েই। নিউমোনিয়া জেনে দশ তলায় উঠেছিলাম। নয় তলায় অনেক পরে নামতে হোল কোভিডকে সঙ্গে নিয়ে।
এবারের ভেজিটেরিয়ান কোভিড ত্রাসের সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয়েছে এ পর্যন্ত। তাই বলে প্রতিদিন দু’চারজন করে ভর্তি হচ্ছেননা, এমনটাও নয়। আইসোলেশন ওয়ার্ডে শুনলাম পরপর আট-নয়টি ঘরে যাঁরা ভর্তি হয়ে রয়েছেন তাঁদের সবার কোভিড। পরের রাতে শুনলাম একজনের গঙ্গাপ্রাপ্তিও হয়ে গেল বেশ নীরবেই।বছর আশি বয়স ভদ্রলোকের, সঙ্গিন অবস্থায় একেবারে শেষ প্রহরে ভর্তি হয়েছিলেন, শেষ রক্ষা হোলনা। অনামী, অজানা হলেও আমার নিকট প্রতিবেশী তো ছিলেন, তাঁর বিদায়ের খবর কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনটা বিবশ করে তুলল। উদ্বেগ হয়নি কারণ আমি তো সেটিং করেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম।
কার সঙ্গে সেটিং?
অবশ্যই সেই সুদর্শন যমরাজের সঙ্গে যিনি ভর্তির দিন দুপুরে ঘুমের মধ্যে আমাকে দর্শন দিয়েছিলেন। গপ্পের উপসংহারে এসে সেটিংয়ের সেই গোপন কিসসা আপনাদের জানিয়ে দেওয়া কী উচিত কাজ হবে? গোপন সমঝোতা বলে কথা, তাই একটু বাধো বাধো ঠেকছে। দয়া করে পাঁচ কান করবেননা, তাতে যমরাজ কুপিত হয়ে পাল্টি খেলে কেস আমার ফের জনডিস হয়ে যেতে পারে।
ফিসফিস করে যমরাজ যা জানালেন তার মোদ্দা কথাটি এই রকম। নরকের পলিটব্যুরো দীর্ঘ রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আপাতত পশ্চিমবঙ্গের কাউকে জায়গা দেওয়া হবেনা। নোটিশ ঝুলিয়ে লিখে দেওয়া হয়েছে,’ কুকুর আর বাঙালির প্রবেশ নিষেধ।’
প্রথম চোটে মনে হোল এর পিছনে গুজরাতি ষড়যন্ত্র থাকলেও থাকতে পারে। পার্থিব বাকি সবকিছুই তো তারা ইতিমধ্যে হস্তগত করে ফেলেছে, নরকের ওপরে খবর্দারিটাই বা বাকি থাকে কেন? বাঙালি নরকে যাবে তা নিয়েও এমন বিমাতৃসুলভ আচরণ! আবাসে, সড়কে, জলে, স্থলে অন্তরীক্ষে কোথাও একটা পয়সা দেবেনা, কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে দিতে নরকের গায়েও ‘নো এন্ট্রি’ বোর্ড লাগিয়ে দেবে?
যমরাজই আমার বিভ্রান্তিটুকু কাটিয়ে দিলেন পিলে চমকানো একটি সত্য বে-আব্রু করে দিয়ে।
আপনি পুরোটাই ভুল ভাবছেন। এর পিছনে কারও খেলা নেই। এটা নরকের পলিটব্যুরোর সিদ্ধান্ত, ট্রাম্পের বাপেও এখানে মাথা গলাতে পারবেনা।
হঠাৎ এমন একটি বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত তাও বাঙালির বিরুদ্ধে। আপনি আমাকে কী ভাবছেন বলুনতো! আমি কি পাগল না তৃণমূল।
যমরাজ- দেখুন নরকে এখন এক ছটাক জায়গা নেই, রোজ গোটা দুনিয়া জুড়ে এত পাষন্ড মারা যাচ্ছে যে বলার নয়। অথচ নরকের সম্প্রসারণ তো করতেই হবে। কোথায় করা যায় তা নিয়ে গভীর ভাবনাচিন্তা ও গবেষণা করে পলিটব্যুরো একটি জায়গা আবিষ্কার করেছে যার অবস্থা নরকের মতো বা তার চেয়েও খারাপ। ফলে প্রাথমিকভাবে স্থির হয়েছে এ জায়গার লোকেরা খামোখা আমাদের নরকে এসে ভিড় বাড়াবে কেন? তারা নিজেদের নরকেই থাকুক। আমাদের ওখানে পটল তোলার পরে আসতে হয়,এখানে দিব্যি জ্যান্ত অবস্থাতেই বৌ-বাচ্চা-বন্ধু-বান্ধব সব্বাইকে নিয়ে থাকা যায়।
সেই জায়গাটা কোথায়? আফ্রিকায়, লাতিন আমেরিকায় নাকি কোনও আরব্য জনপদ?
যমরাজের ওষ্ঠে এবার নয়ন ভোলানো হাসি। ‘ আপনি নিজের রাজ্যের কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন?’
ছেলেবেলায় পড়া একটি বাংলা বইয়ের শিরোণাম হঠাৎ ফ্ল্যাশ ব্যাকে ভেসে উঠল।
‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ।’ (শেষ)