Home সুমন নামা অসময়ে কোভিড (৩)

অসময়ে কোভিড (৩)

সুমন চট্টোপাধ‍্যায়

by developer developer
0 comments

আপনাদের ভালোবাসা, শুভেচ্ছা, সহমর্মিতার এমনই মহিমা যে ধেড়ে খোকা স্বগৃহে প্রত‍্যাবর্তন করেছে বীর বিক্রমে। শরীরটা বড়ই দুর্বল, মনে হচ্ছে গাজার যে কোনও দালানের মতো উপর্যুপরি কামান গোলায় ভিতরটা ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। তাই ভিডিওয় বিরতি চলবে, লেখা থামবেনা। বেলঘরিয়ায় আমার পানসি পৌঁছবেই পৌঁছবে।]

আমি ঘুমিয়ে পরলে স্বপ্ন দেখবই দেখব, বনে, রণে, জলে, জঙ্গলে যেখানেই হোক না কেন। যা ঘটমান বর্তমান, আমার স্বপ্নে সেসব চিত্রকল্প, সংলাপ ফিরে ফিরে আসে, বলতে পারেন যেন প্রাত‍্যহিক খবরেরই নানাবিধ ছায়া-রূপ। খবরওয়ালা হয়ে জন্মানোর ‘ অ‍্যাকিলেস হিল’, জাগরণের ঘটনা বা রটনা স্বপনেও লাল পিঁপড়ের মতো সারিবদ্ধভাবে ধেয়ে আসে, বেশিরভাগ সময় মনের ওপর সুড়সুড়ি দিয়ে সরে যায়, তাদের মেজাজ মর্জি ভালো না থাকলে কুটুস করে কামড়েও দেয়।

‘আমি স্বপনে রয়েছি ভোর সখী আমারে জাগায়োনা’, ঠাকুরবাড়ির বনেদি পালঙ্কে না ঘুমতে পারলে অসম্ভব। স্বপ্ন দেখতে দেখতে টাকার ফেনিল ঢেউয়ের তলায় নিশ্চিন্তে ডুবতে থাকব, আমার বলিরেখা-ক্লিষ্ট ললাটে তেমন প্রাপ্তিযোগও নাস্তি। ও সব সত‍্যজিৎবাবুর নায়কদের পোষায়, আমিতো চিহ্নিত খলনায়ক।সব্বাই জানে, ‘নায়ক নেহি, খলনায়ক হুঁ ম‍্যায়/ জুলমি ওয়াদা দুখদায়ক হুঁ ম‍্যায়/ হায় পেয়ার কেয়া মুঝকো কেয়া খবর/ বস ইয়ার নফরতকে লায়েক হুঁ ম‍্যায়।’

হাসপাতালে আইসোলেশন রুমের এক ফালি বিছানার ক্লান্ত ঘুমের মধ‍্যে হঠাৎ এক আগন্তুক দর্শন দিলেন, আগে কোথাও কখনও তাঁকে দেখেছি বলে মনে পড়লনা। শরীরের মধ‍্যপ্রদেশে আঙুলের আলতো টোকা দিয়ে কানে কানে বললেন,’সুমনবাবু আমি যমরাজ। আপনার সঙ্গে দুটো কথা ছিল।’

যমরাজের নাম শুনলে পিলে চমকে যাওয়ার কথা, আশ্চর্য, আমি তিলমাত্র ঘাবড়ে গেলামনা, মনে হোল নিশ্চয়ই বুদ্ধির ঢেঁকি ওই বেহারি হুচুম্ফু ফিরে এসে ঘুমন্ত প্রৌঢ়কে একটু চুলকে দিতে চাইছে।পাত্তা দিলামনা, ঘোরতর বিরক্ত হয়ে বলে ফেললাম,’ পেঁয়াজি হচ্ছে? ফোট শালা। যমের বাপ এলেও আমি এখন চোখ খুলবনা।’

মাস্তানি করতে বলে দিলাম, তবু যমরাজ না যুবরাজ কে এসেছে সেই কৌতুহল মেটাতে আপনা থেকেই মনঃশ্চক্ষু খুলে গেল। যমের নাম শুনলে মনের পর্দায় যে বীভৎস মূর্তিটি ভেসে ওঠে, আমার ঘরে দু’দন্ড আলাপ করতে আসা ভদ্রলোকের চেহারার সঙ্গে তার এক ছটাক মিলও নেই। কাঁচা সোনার মতো গাত্রবর্ণ, উন্নত নাসিকা, সুঠাম চেহারা, উচ্চতা কম করেও ছ’ফুটের বেশি, ওষ্ঠের কোনায় আলতো মিষ্টি হাসি, রসে ভরা আঙুর যেন। পহেলা ঝটকায় মনে হোল এমন কন্দর্প কান্তি শশী থরুর ননতো!

সসম্ভ্রমে উঠে বসে নমস্কার জানিয়ে বললাম,’ আপনি হঠাৎ ভর দুপুরে হাসপাতালের অচ্ছুত ওয়ার্ডে চলে এলেন? আমার ছুটির ঘন্টা তাহলে বেজেই গেল নাকি! কোভিডের রিপোর্ট না দেখে আমি কিছুতেই আপনার সঙ্গী হতে পারবনা। এতগুলো টাকা জলে যাবে সঙ্গে প্রাণটাও, হতে পারেনা। এমার্জেন্সির ভুলভুলাইয়ায় আপনি বোধহয় ভুল লোকের ঘরে ঢুকে পড়েছেন।’

যমরাজ আমতা আমতা করে কী য়েন জবাব দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে গেলেন, আমি তাঁকে অসভ‍্যের মতোই জোর করে থামিয়ে দিলাম।’আপনি তো দেখছি শ্রীমতী ভয়ঙ্করীর পেয়াদাদের মতো আচরণ করছেন! তুলে নেওয়ার আগে একটা নোটিশ তো অন্তত পাঠাবেন। নতুন ভারতীয় ন‍্যায় সংহিতা মন দিয়ে পড়ে ওঠার সময়টুকু পাননি বুঝি!’

আবার যমরাজের মুখ খোলার চেষ্টা আবার আমার মুখ ঝামটা! ‘ দেখুন আমাকে চমকে কোনও লাভ হবেনা। হোঁদল কুতকুতের পাঠানো পেয়াদা আমাকে বিশ মাস নরক-বাস করিয়েছে, ভেবেছিল ওখান থেকেই বডি পুরীর স্বর্গদ্বারে এমনিতে চালান হয়ে যাবে, হর হর মহাদেবের মতো ঘর ঘর করাল-করোনার মহামারির মধ‍্যে। পারল কী? শরীর-মন-সারা জীবনের সঞ্চয় সব তছনছ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু উইকেটটাতো তুলতে পারেনি। আর আপনার গন্ডমূর্খ, ভুঁড়িওয়ালা পেয়াদারা তো ঠিক করে মিথ‍্যে কেস সাজাতেও পারবেনা। তিন দিনের মধ‍্যে হাইকোর্টে বারো শিক্কের থাপ্পড় খাবে। তখন?’

সাহেব যমরাজের ইগো হার্ট হোল মনে হয়।’ আপনাকে আমি মোটেই তুলে নিতে আসিনি। বরং একটা সুখবর দিতে এসেছি। তা আপনি তো আমার কোনও কথা শুনতেই চাইছেননা।’

বলে কী! যমরাজ আর সুখবর, রেড়ির তেল আর ঝর্ণার জল, একসঙ্গে কখনও মিশ খায় নাকি? ফাজলামি বন্ধ করে চুপচাপ তাঁর কথা শুনব বলে মনস্থ করলাম। ঠিক দু’ মিনিট পনেরো সেকেন্ড সময় নিয়ে আমার কর্ণ কুহরে তিনি যে সুধারস ঢেলে দিলেন তাতে অশান্ত মন বাসকিন রবিন্সের পিশতাচিও আইসক্রিম হয়ে গেল। আপন মনে স্বপ্নের মধ‍্যেই গুনগুন গাইতে শুরু করে দিলাম,’ আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি।’ কোন শালা বলে দুয়ারে যমরাজ অনেকটা দুয়ারে সরকারের মতোই ঘাঁটা কেস!’

তন্দ্রা ফের একটু ঘন হব হব করছে, কানের পাশে সত্যিই বাঁশির মিহি আওয়াজ। চোখ খুলে দেখি বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমার ঘরনী আর ডাক্তারনি। ঘরনীর পরিচিত মলিন মুখ, ডাক্তারনির কপট গাম্ভীর্য।

‘এই যে মশাই, করেছেনটা কী?’ ভ‍্যর্ৎসনা আর ভদ্রতাবোধের মাঝখানে কোনও সবুজ প্রান্তর থেকে প্রশ্নটি উঠে এল যেন। টু প্লাস টু করতে হাফ সেকেন্ডও লাগলনা, বুঝে গেলাম এই মহিলার কাছেই পার্থ আমাকে ডেসপ‍্যাচ করে দিয়েছে। নারী-শাসনে থাকা বলতে কেবল গৃহিনীর মায়াজাল বুঝে এসেছি, এখনও তাই বুঝি, একদিন যে লেডি-ডাক্তারের খাঁচার মুর্গি হতে পারি এমন অশুভ চিন্তা কদাচ মনেই আসেনি।

হয়ত ব‍্যাপারটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়ই হবে, তার বেশি কিছু নয়। ভুল করেও এর মধ্যে পেট্রিয়ার্কির বোঁটকা গন্ধ খুঁজতে যাবেননা, মানুষ হিসেবে নারীকে আমি পুরুষের অনেক ওপরে বসিয়ে রেখেছি নিজের বিশ্বাস আর অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত, সশ্রদ্ধ উপলব্ধি থেকেই। তাছাড়া আমার দুই আদরের তুতো-বোন চৈতী আর মিতা দাপুটে ডাক্তার, ডাক্তারবাবু ভর্তি আমার শ্বশুরালয়, প্রয়াত শ্বশুর মশাই করুণাময় দত্ত আমাদের সবার কাছে বিশ্ব-চরাচরের সেরা ডাক্তার, জীবন্ত ধন্বন্তরী।আমার গিন্নিও থ্রি-কোয়ার্টার ডাক্তার, শুনে শুনে মুসলমান বনে যাওয়ার মতো। চলে যাওয়ার আগে বেশ কয়েক বছর আমার বাবা একজন ডাক্তারকেই প্রকাশ‍্যে স্বীকৃতি দিতেন, কস্তুরী। নতুন ডাক্তারনিকে দেখে ভয়ে হৃদয় কম্পিত হবে আমার হৃদয় আদৌ ততটা দুর্বল নয়, পাষান তো নয়ই।

ডাঃ সুস্মিতা রায়চৌধুরী। পালমোনোলজিস্ট। বহুকাল আগে সরকারি চাকরি ছেড়ে পার্থ তার স্বাধীন প্র‍্যাকটিশ শুরু করেছিল ফুলবাগান চত্বরে অর্কিড নামের একটি ছোট্ট আলো-আঁধারি নার্সিংহোম থেকে। সুস্মিতাকে সেখানেই প্রথম দেখেছিলাম, পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়নি।
মাঝখানে বহু বছরের ব‍্যবধান, স্মৃতির ম‍্যাজিক স্লেট থেকে ক্ষণিকের দেখা মুখচ্ছবি ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল। এবার তাঁকে শুধু দেখলাম আর চিনলাম বললে কিছুই বলা হবেনা, বলতে পারেন একজন অতি-সুদক্ষ, আনখশির পেশাদার,আত্মপ্রত‍্যয়ে ভরপুর, স্বাভাবিক নেতৃত্বদানের ক্ষমতা সম্পন্ন নারী-মূর্তিকে আবিষ্কারই করে ফেললাম। সেই আবিষ্কারের কিসসা আমি এখন বলছিনা, কোনও একদিন বাংলাস্ফিয়ারের ক‍্যামেরার সামনে সুস্মিতাকে ধরে আনব বলে। তখন বুঝবেন আপাতত কেন ট্রেলরটুকুতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখছি।

সুস্মিতার প্রাথমিক সম্বোধনে কেমন যেন একটা ঝাঁকুনি দেওয়ার সচেতন চেষ্টা ছিল যা আমার মোটেই মনঃপূত হয়নি। চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে দেখতে পাচ্ছে এক প্রৌঢ় চিত্তির হয়ে ঘুমোচ্ছে, তাকে “ কী মশাই, করেছেনটা কী বলা হচ্ছে কেন?”

কেন তেমন কোনও অপরাধ করে ফেললাম নাকি?

না, এই যে হাসপাতালে আসব কি আসবনা বলে গড়িমসি করছিলেন।

সে পর্ব তো চুকে গিয়েছে। ঘন্টা তিনেক হয়ে গেল হাতের শিরা ফুটো করে গ‍্যালন গ‍্যালন রক্ত নিয়ে গেল, তার একটা রিপোর্টও দেখতে পেলামনা।

ফ্লু নেই। কোভিড রিপোর্ট এখনও আসেনি। তার বদলে আপাতত দেখতে পাচ্ছি দুটো ফুসফুসে মৌচাকের সাইজের দুটো নিউমোনিক প‍্যাচ। আর সি আর পি বেড়ে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে একদিন দেরি করে এলে খেলা আমার হাতের বাইরে চলে যেতে পারত! তাই বলছি এক্কেরে ঠিক সময় ঠিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছেন।

সি আর পি বলতে বরাবর সেন্ট্রাল রিজার্ভড ফোর্স বুঝে এসেছি। শরীরের রক্ত-কণিকাতেও যে সঙ্গিনধারীরা বসে থাকতে পারে, ইতিহাস পড়া গোমূর্খ আমি তা জানব কী করে।

কত থাকা উচিত?

পাঁচের নীচে।
বেড়ে হোল কত?
১৮৯।
তা এটা কেন এমন বিপজ্জনক?
ভর্তি হয়ে ঘরে বসে একবার গুগল করে নেবেন, সব বুঝে যাবেন।

আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। খান্ডারনি ডাক্তারতো জানেননা আমি গুগল দেখলে ঘেঁটে ঘ হয়ে যাব, দেখবে কস্তুরী, তারপর ওর কাছ থেকে টিউটোরিয়াল নিয়ে নেব।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আমার কিছু হবেনা। সি আর পি-কেন আমেরিকার নেভি সিল নেমেও কিছু করতে পারবেনা। শুধু জেনে ফিরবে আমি যমেরও অরুচি।

মানে?

মানে আমার সেটিং হয়ে গিয়েছে।আর কোনও বিপদ নেই। (আগামীকাল সমাপ‍্য)

You may also like

Leave a Comment

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles

All Right Reserved.