Home সুমন নামা অসময়ের কোভিড

অসময়ের কোভিড

সুমন চট্টোপাধ‍্যায়

by developer developer
0 comments

ডাক্তারের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, হাসপাতালে পৌঁছে আমায় এমার্জেন্সিতে বডি ফেলতে হবে, সেখানে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে, সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে তিনি ঠিক করবেন আমি বাড়ি ফিরতে পারব না ওই পঞ্চতারকা কসাইখানায় ( যাকে কর্পোরেট হাসপাতাল বলা হয়ে থাকে) গ‍্যারেজ হয়ে যেতে হবে। তথাস্তু।

গত সাত বছরে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ সময় আমি হাসপাতালেই দিন যাপন করেছি। ভুবনেশ্বরে, কলকাতার বিবিধ হাসপাতালে। আর গত সাত মাসে আমাকে একই হাসপাতাল ডান হাঁটুর মালাইচাকি উপরে ফেলতে, তার সেলাইয়ের দাগ মুছে যাওয়ার আগে অকস্মাৎ এবার আবার। প্রথমটি ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত, দ্বিতীয়টি বিনা মেঘে বজ্রপাত।

তার দিন সাতেক আগে থেকেই আমার শরীরটা কেমন যেন পাগলা মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতো আচরণ করছিল। প্রথমে তীব্র মাথাঘোরা,পরের দিন জ্বর, তার পরের দিন মারকাটারি পেট খারাপ তারপরের দিন আবার জ্বর বাবা-জীবনের সগৌরব প্রত‍্যাবর্তন। এই সাত দিন আমি কলকাতায় ছিলামনা, বাড়ি ফেরার পথে প্লেনে বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে একটিই প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কেসটা কী?

কলকাতায় ফিরে নিজের বিছানায় বডি এলিয়ে দিতেই মনে হোল শরীরটা কেমন যেন অতলান্ত দুর্বলতায় ডুবে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। হঠাৎ মনে হোল কোভিড হয়নি তো? জনা দুয়েক ভ্রাতৃসম ডাক্তারকে খবর দিতে তাঁরা বরাভয় দিলেন এবারের কোভিড নাকি বাসন্তী হাওয়ার মতো ফুরফুরে, তার দংশনে কোনও জ্বালা নেই, হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে এসে ক্ষণিকের অতিথির মতো হঠাৎই আবার কেটে যাচ্ছে।

কিচ্ছু করতে হবেনা তোমাকে, বাড়িতে বিশ্রাম নাও, জ্বর বাড়লে প‍্যারাসিটামল আর সারা দিন ধরে প্রচুর জলপান। নো চিন্তা, নট কিচ্ছু। তাই সই।

রাত বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সংযোজন এবার মৃদু শ্বাসকষ্ট। সি ও পি ডি নিয়ে যুগ যুগান্ত ধরে ঘর করছি, শ্বাসনালীতে এমন খুচরো ব্লকেজ হামেশাই ঝামেলা পাকায়, বার কয়েক ইন হেলারে ফুঁ মারলেই স্বস্তি ফিরে আসে। ভাবলাম, ঘর কা মুর্গি ডাল বরাবর, তাকে অযথা গুরুত্ব কেনইবা দেব। পাফ নিলাম বীর বিক্রমে, ফল হোলনা। বুকের ভিতরে কুকুর ছানার কুঁই কুঁই আওয়াজ কমার বদলে কিঞ্চিৎ বোধহয় বেড়েই গেল।

বাড়িতে দু’দুটো অক্সিমিটার ছিল, আসল করোনা মহামারী কালের মলিন রেলিক। ওই যন্তর দুটোকে দেখলে এখনও আমার বুক কেঁপে ওঠে, ভুবনেশ্বরের হাসপাতালে আমার গিন্নির যমে-মানুষে টানাটানির বিধুর বিষন্ন স্মৃতি মনে পড়ে যায়। হাসপাতালের একই ঘরে আমরা সর্বক্ষণ একসঙ্গে সময় কাটাতাম অথচ পরীক্ষার পরে দেখা গেল কস্তুরীর রেজাল্ট পজিটিভ আর আমারটা নেগেটিভ।দু’জনের একসঙ্গে পজিটিভ হলে কত ভালো হোত, দু’জনকে সহসা বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই হাসপাতালের বিছানায় বন্দী থাকতে হোতনা, তেমনটা হলে সহ-মরণেও চলে যেতে পারতাম, নিঃশব্দে, প্রভু জগন্নাথের পদতলে। আমার হাতের ভাগ‍্যরেখা বড়ই এবড়ো-খেবড়ো, আতস কাচের তলায় রাখলেও দেখতে সেই খাইবার পাসের মতোই লাগে। ফলে স্বর্গসুখলাভের অমন সুবর্ণ সুযোগও হাতছাড়া হয়ে গেল!

তারপর ওই মহামারিকালে আমি গুনে গুনে ১৭বার কোভিড টেস্ট করিয়েছি, প্রতিবারই নেগেটিভ। ফলে আমার প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাস ছিল আমার শরীরে এমন কোনও লাঠিয়াল দারোয়ান আছে যাকে টপকে আসতে কোভিড ভয় পায়। সমুদ্র-শয‍্যায় শুয়ে যখন কিছু হয়নি, তখন পানা পুকুরকে নিয়ে মনে কোনও দুর্ভাবনাই ছিলনা। কোভিড? চলবেনা, নতুন কোনও রোগের নাম বলো।

অব‍্যবহারের কারণে বাড়ির দুটো অক্সিমিটার নিথর হয়ে পড়ে আছে, ব‍্যাটারি মায়ের ভোগে।বাড়িতে তখন আমার সন্তান সম ঈশ্বরের দূত উপস্থিত ছিল, সে দৌড়ে গিয়ে একটি নতুন যন্ত্রই কিনে আনল। ফুটোয় আঙুল ঢোকাতেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। অক্সিজেন স‍্যাচুরেশন লেভেল ঝপ করে ৮১-তে নেমে এসেছে। আবার চেক। আবার একই ফল। তার মানে কেস জন্ডিস।

হাসপাতালে যাব কী যাবনা নিয়ে তখনও টালবাহানা করছি। তিরিশ বছর ধরে আমার ফুসফুসের জিম্মাদার ডাঃ পার্থ সারথি ভট্টাচার্য নিদান দিলে বাড়িতে এখনই একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার আনাও আর সারা রাত নাকে নল গুঁজে শুয়ে থাক। কাল সকালে স‍্যাচুরেশন কোথায় থাকে দেখে তারপর ব‍্যবস্থা। সারা রাত বেহেড মাতালের মতো অক্সিজেন টেনেও ফুসফুস তেমন চাঙ্গা হোলনা। বিনা অক্সিজেনে ছিল ৮১, পেট-ভর অক্সিজেন টেনে উঠে হোল ৮৯।

না সুমনদা ভালো ঠেকছেনা। হাসপাতালে যাও। ডাক্তারের নাম, ফোন নং সব সেই জুগিয়ে দিল। সম্ভবত টেলিফোনে সেই ডাক্তারকে টেলিফোনে চুপিচুপি বলেও দিয়েছিল, ইনফ্লেমেটারি মেটেরিয়াল। হ‍্যান্ডল উইথ কেয়ার। (চলবে)

You may also like

Leave a Comment

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles

All Right Reserved.