জ্যোতির্ময় দত্ত

আমার নাই বা হল পারে যাওয়া (দ্বিতীয় খণ্ড)

সুমন চট্টোপাধ্যায়

বন্দীশালায় দিন-যাপনের একটা বড় সুবিধে হল বই পড়ার নিরবিচ্ছিন্ন অবকাশ। গত ছয় মাসে আমি যত বই পড়লাম, গত ছয় বছরে তা হয়ে ওঠেনি। সেই অবিন্যস্ত দীর্ঘ তালিকায় শেষ সংযোজন জ্যোতির্ময় দত্তের আত্মকথার দ্বিতীয় খন্ডটি– আমার নাই বা হল পারে যাওয়া।

এই আত্মকথার প্রথম খন্ডটি প্রকাশিত হবার পরে মন্ত্রমুগ্ধ আমি এই সময় কাগজে পাতা-জোড়া আলোচনা লিখে বড় তৃপ্তি পেয়েছিলাম। লেখক কে চিনি বলে ভয় ছিল ঘাট দেখে বসে না পড়েন। মিমিদির দৈনন্দিন যাতনা আর প্রণোদনায় তেমন অঘটন যে শেষ পর্যন্ত ঘটেনি তা বড় সুখের খবর। জ্যোতিদার ব্যক্তি-জীবনের কোহিনূরটি হলেন তাঁর স্ত্রী-ধন যার একমাত্র রেপ্লিকাটি দেখা যায় টাওয়ার অব লন্ডনে।

কবি জ্যোতির্ময় আসলে গদ্যে পদ্য লেখেন। সেই লেখার কাব্যময়তা এতটাই মনোমুগ্ধকর যে মনে হয় যেন জোয়ারের গঙ্গায় পা ডুবিয়ে বসে আছি। একবার পড়তে শুরু করলে এক নিঃশ্বাসে শেষ না করে উপায় থাকেনা। পাঠক সেখানে নেহাতই নিরুপায়। তবু মুগ্ধতার মধ্যেও আমার কেন জানিনা মনে হয়েছে জ্যোতিদা উপরোধের ঢেঁকি গিলতে গিলতে আত্মকথা লেখার কাজটা ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলতে চেয়েছেন। এই আলস্যের মধ্যেও লুকিয়ে আছেন পরিচিত ‘ কুইন্টেসেনশিয়াল’ জ্যোতি দাদা, অনেক দিন ধরে একটাই কাজ করে যাওয়াকে যিনি পন্ডশ্রম ছাড়া আর কিছুই মনে করেন না, আর সেই কাজটি যদি নিজের পেঁচাল পড়া হয় তাহলে তো আর কথাই নেই।

আমার তাই মনে হচ্ছে প্রথম খন্ডটি লিখতে বসে তিনি যদি ডান হাতে কলম ধরে থাকেন, দ্বিতীয়টি লিখেছেন বাম হাতে। ডান হাতে জ্বলে উঠেছিল উদ্যত খড়্গ, বাম হাতে শুধুই রাখাল ছেলের বাঁশি। লেখার শেষের দিকে এসে বেশ বোঝা যায় তাড়াহুড়ো করে ইতি টেনে তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাইছেন। যে হাতেই ধরে থাকুন, জ্যোতির্ময় দত্ত আসলে তো কলম দিয়ে লেখেন না, তুলি দিয়ে লেখেন। ফলে ইচ্ছেয় হোক অথবা ঘোর অনিচ্ছায়, তাঁর হাতের জাদুতে চন্দ্রবিন্দুও আসলে শিল্পের স্তরে উন্নীত হয়ে যায় যে!!

‘ আমার নাই বা হল পারে যাওয়া’-র পরিবর্তে দ্বিতীয় খন্ডটির শিরোনাম ‘ আমার নাই বা হল সিংহলে যাওয়া’ লিখলেও খুব ভুল কিছু হত না। বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে সেটাই হত আদর্শ শিরোনাম। কেন না এর অর্ধাংশ জুড়ে আছে সুন্দরী ‘ মনিমেখলার’ সাগর-পাড়ি দেওয়ার বিস্ময়কর কাহিনী। এই কাহিনীর অনেকটাই আমার জানা। কিন্তু জানা নেই যাঁর তিনি এই পাগলামির অভিযানের আতরমাখা রূপকথাটি কেবল অবিশ্বাস্য বোধ করবেন না, তাঁর শরীরের সব কয়টি রোমকূপ খাড়া হয়ে উঠবে। লেখক ও তাঁর দুই সঙ্গীর– আজিজুর রহমান ও মায়া সিদ্ধান্ত– দুর্জয় সাহসের সামনে তাঁর মাথা নুইয়ে পড়বে এমনি এমনি। একটি খালচরা সামান্য ডিঙি নৌকো কে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে এদেশের সবচেয়ে বিপদসঙ্কূল সমুদ্র পথে বের হবার জন্য যে কলজের প্রয়োজন, মাছে-ভাতে সুখে থাকতে অভ্যস্ত বঙ্গজীবনে চট করে তা খুঁজে পাওয়া যাবেনা। মনিমেখলার যাত্রা আসলে তাই ব্যর্থ নয়, সাহস, সৌকর্য, প্রকৃতি প্রেম আর রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের সার্থক নামা।

প্রতিটি মানুষেরই আসলে দুটি মন থাকে, যাদের মধ্যে টানাপোড়েন চলতে থাকে জীবনের অনেকটা সময় ধরে। একটা মন বাইরের অন্যটি ভিতরের। বাইরের মনটা চায় সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা। আর ভিতরের মনটা চায় ছক ভাঙতে, নিয়ম অমান্য করতে, বাইরের মনের যা কিছু চাওয়া তার কাছে কিছুতেই বশ্যতা স্বীকার না করতে। জ্যোতির্ময় দত্ত আমার জীবনে দেখা একমাত্র মানুষ যিনি সারাটা জীবন কেবল মনের ডাকে সাড়া দিয়ে গিয়েছেন, বাইরের মনের ছলনাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। সেজন্য কোনো প্রতিষ্ঠান তাঁর পায়ে বেশি দিন বেড়ি পড়িয়ে রাখতে পারেনি, তিনিও চাননি, অর্থ, মদমত্ততা বা প্রতিপত্তির জন্য নিজেকে খাঁচায় বন্দী রাখতে। তিনি যেন তাসের দেশের সেই রাজপুত্র যিনি অচলায়তনের সব নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিয়েছেন ভিতরের মনটা বেসুরো গাইতে শুরু করে দিলেই।

আমাদের মতো চিরেতন,হরতন, ইস্কাবনদের তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, যে জীবন কেবল বাইরের মনটার পদানত হয়ে থাকে সেটা কোনো জীবন নয়। তাঁর জীবনের একমাত্র ঈশ্বরীর নাম ‘ ইচ্ছে’! কেন? না সেই তো দিচ্ছে সেই তো নিচ্ছে। তোমরা সবাই মালিকের দাসত্ব করো আমি থাকব ইচ্ছে-দাস।

সত্তরের দশকের শেষ দিকে চুটিয়ে সাংবাদিকতা করছিলেন তিনি, সব্যসাচী হয়ে বাংলা-ইংরেজি দুটি ভাষাতেই অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো কলম চলছিল তাঁর।শাসকের নিদ্রাসুখ ঘুচে গিয়েছিল তাঁর কলম থেকে নির্গত ব্লিৎক্রিজে। তারপর কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ একদিন তাঁর ভিতরের মনটা বলে উঠল,’ ঢের হয়েছে তোর মসী চালনা, সাগর ডাকছে যাবি না?’ ব্যস, পেখমের মতো পাল তুলে মনিমেখলা ভাসতে শুরু করে দিল সাগরের বুকে।পারে পড়ে থাকল মোটা বেতনের চাকরি, দারা- পুত্র পরিবার। জীবনকে বাজি ধরে, দুই অনভিজ্ঞ সঙ্গীকে নিয়ে বিজয় সিংহের মতো তিনি চললেন সিংহল বিজয়ে। সকলের মধ্যে জ্যোতি দাদা স্বতন্ত্র কেননা রবীন্দ্রানুরাগী হয়েও পাগলা মনটাকে তিনি কোন দিন বাঁধার চেষ্টা করেননি। তিনি এতটাই স্বতন্ত্র যে আমার স্থির বিশ্বাস, দুনিয়ার সেরা জিন বিজ্ঞানীও জ্যোতির্ময় দত্তের একটা ক্লোন বানাতে পারবেননা।

জ্যোতির্ময়ের জন্ম ১৯৩৬ সালে। মানে তিনি এখন সবে তিরাশি। এই বয়সে পৌঁছে গড়পড়তা বঙ্গ সন্তান কী করেন? একদিকে জরা ও অসুখ আর অন্যদিকে স্বজনের অবহেলায় যন্ত্রণা বিদ্ধ হতে হতে মনে মনে গুনগুন করে,’ হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পার কর আমারে।’ বৈতরণী কোনো মতে পার হতে পারাটাই যখন জীবনের অভীষ্ট হবার কথা, তখন একমাত্র জ্যোতিদাদাই সম্রাটের মতো অবজ্ঞায় আত্মকথার শেষ পংক্তিতে এসে লিখতে পারেন,’ এই স্মৃতিকথায় যে ঘটনা গুলি বিবৃত হল, তা হোক গৌরচন্দ্রিকা মাত্র। আসুন শ্রী যুক্ত ভবিষ্যৎ, আমার দরজা খোলা।’

শুনেছি দীর্ঘ প্রবাস জীবনে ইতি টেনে দত্ত দম্পতি কলকাতায় থিতু হয়েছেন। আমার কাছে এ বড় সুখের খবর। জেলখানার কপাট খুললেই শ্রী যুক্ত ভবিষ্যতের দুন্দুভি বাজাতে আসছি আমি। তিতিরকে বলে রেখ, দরজাটা যেন খোলা রাখে।

(ভুবনেশ্বর জেলে বসে লেখা)

Author

Leave a reply

  • Default Comments (0)
  • Facebook Comments
  • Disqus Comments

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles