Home বিনি পয়সার ভোজ

বিনি পয়সার ভোজ

0 comments 15 views

সুমন চট্টোপাধ্যায়

আমাকে অনেকেই বলেছেন, বাঙালির কাছে ডিজিটাল মিডিয়া নাকি বিনি পয়সার ভোজ। মানে আমি লিখব, আপনি পড়বেন, বিনিময়ে আমি যদি যৎসামান্য দক্ষিণাও চাই, আপনি মুখ ঘুরিয়ে নেবেন।
এই মিডিয়ায় আমি নেহাতই নাদান, তাই ভাবলাম আপনাদেরই জিজ্ঞেস করি আমি যা শুনেছি সেটা কি সত্যি?

বাজারে রদ্দি অথবা অর্বাচীন যৌনতা অথবা টালিগঞ্জের দু’কড়ির নায়ক-নায়িকার এই প্রেম এই বিচ্ছেদের গপ্পো অথবা শোভনের মতো বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ ওঠার কিসসা অনবরত ছাপিয়ে যাওয়াই দেখছি ডিজিটাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তার অত্যাবশ্যক শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের লক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য হওয়া নয়, চাটনি ব্যতীত ভোজনের পাত্রের অন্য কোনও পদের দিকে তাকানো নয়, এমনকি আত্মনির্ভর হওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টাও নয়। এদের একমাত্র লক্ষ্য লাখ লাখ মানুষের নজর কাড়া আর করোনার মতো তাদের রগরগে কাহিনী সমগ্র ভাইরাল করে দেওয়া, আকাশে, বাতাসে, অন্তরীক্ষে।

লাখ লাখ কৌতুহলী চোখ নিজের দিকে টানতে পারলে মা লক্ষ্মী যদি সদয় হতেন, তবু তার একটা অর্থ থাকত, খবরের কাগজে যেমনটি থাকে। যে কাগজের প্রচার সংখ্যা যত বেশি, সেই অনুপাতে তার ততবেশি বিজ্ঞাপন পাওয়ার কথা। আর এই বিজ্ঞাপনই হোল খবরের কাগজের লাইফ-লাইন, কেন না কাগজ বেচে যে সামান্য পয়সা আসে, তা দিয়ে খরচের কিয়দাংশও মেটে না। সব লোকসান পুষিয়ে দিতে হয় বিজ্ঞাপন দিয়ে।

ডিজিটাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে তেমনটি হচ্ছে বলে তো মনে হয় না। সাইটে কয়েক মিলিয়ন হিট কিন্তু গুগলের দেওয়া বিজ্ঞাপনের বাইরে তেমন কিছুই নেই। গুগল বাবাজির বিজ্ঞাপন যে কী বিষম বস্তু, আমার নিজেরই সেই অভিজ্ঞতা আছে। আমি যখন মন দিয়ে আমার ব্লগ-সাইট বাংলাস্ফিয়ারের কাজ করছিলাম, হঠাৎ দেখি একদিন না চাইতেই গুগলের বিজ্ঞাপন আসতে শুরু করেছে, তাও সিঁদুর-আলতা-হাওয়াই চটি- গর্ভ নিরোধকের পাতি বিজ্ঞাপন নয়, প্রত্যেকটি প্রিমিয়াম সেগমেন্টের বিজ্ঞাপন। দেখে আমি তো আহ্লাদে ষোলো খানা। মাস খানেক পরে গুগল একটি গম্ভীর বার্তায় জানাল এক মাসের অত বিজ্ঞাপনের জন্য আমার প্রাপ্য হয়েছে দুই ডলার। ভাবতে পারেন? এখন ব্লগ-সাইটটি অনিয়মিত হয়ে যাওয়ায় দেখতে পেলাম গুগল নিজের বিজ্ঞাপনগুলি তুলে নিয়েছে। বাঁচা গিয়েছে, ফের কোনও দিন বাংলাস্ফিয়ার যদি ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে আমি আর গুগলের বিজ্ঞাপন ছাপব না। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করার কোনও মানেই হয় না।

আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস গ্রাহকের সানুগ্রহ আনুকূল্য না পেলে ডিজিটাল মিডিয়া বাঁচবে না, বাঁচতে পারে না। পশ্চিমের দেশগুলিতে নগদে গ্রাহকমূল্য চুকিয়ে না দিলে কিচ্ছুটি পড়ার আর উপায় নেই। দ্য গার্ডিয়েনের মতো দু-একটি কাগজের সাইটে এখনও ফোকটে প্রবেশ করা যায়, তবে সেখানেও প্রতিটি লেখার তলায় কাতর নিবেদন থাকে ডোনেশনের। এক পাউন্ড দিন, তাই সই।

আমাদের দেশে এই রেভিনিউ-মডেল এখনও শিকড় গাড়তে পারেনি, পশ্চিমবঙ্গে তো প্রশ্নই নেই। বিনা পয়সায় পড়তে পারাটা যেন আমাদের মৌলিক অধিকারের পর্যায়ভূক্ত হয়ে গিয়েছে। বছরে হাজার টাকার ওপরে গুনাগার দিয়ে যে বাঙালি গতকালের খবর আজকের কাগজে পড়ে তারা ডিজিটাল মিডিয়ার জন্য যৎসামান্য খরচ করবেন না কেন? পয়সা না এলে ছেলে-মেয়েগুলো বাঁচবে কী করে, কে জোটাবে তাদের বেতন, কী ভাবে নতুন প্রতিভা আকৃষ্ট হবে এই মিডিয়ায়। বিশ্বাসযোগ্যতা যেমন সাংবাদিকের দায়বদ্ধতা, তেমনই পাঠকের সামাজিক দায়বদ্ধতা হল সাংবাদিক-লেখক- কবিদের পাশে দাঁড়ানো।

এখন আমি ন্যাংটা, কোনও বাটপারকে ভয় পাই না। যার কিছুই নেই তার নতুন করে হারানোরও কিছু থাকে না। ফলে আমি যদি মন দিয়ে ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করি পয়লা দিন থেকে গ্রাহক-দক্ষিণা চাইব। আপনারা সাড়া দিলে গাড়ি চলবে, না দিলে স্টেশন থেকে বেরোবেই না।

তবে হ্যাঁ, ভ্যালু ফর মানির সঙ্গে কোনও আপস নেই, কড়ি যত ফেলবেন তেল পাবেন তার চেয়ে বেশি।
খুব ভুল বললাম কি?

Author

Leave a Comment

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles

All Right Reserved.