আমরা এখন কলরব, তীক্ষ্ণ চিৎকার আর উচ্চকিত বিবাদের আবহে বাস করি। প্রত্যহ উঠে আসে নানা বিবাদস্পদ বিষয়।বাংলাস্ফিয়ার মনে করে তার মধ্যে কয়েকটি বিষয় অতি গুরুত্বপূর্ণ যা সম্পর্কে আমাদেরও সুস্পষ্ট মতামত থাকা জরুরি। আজ সেই চর্চার শুভারম্ভ।
আগামী ২৫ জুন দেশে জরুরি অবস্থা জারির অর্ধশতবর্ষ পূর্তি হবে ।কেন্দ্র চায় গোটা দেশ একযোগে এই দিনটি ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করুক। রাজ্যে রাজ্যে এই মর্মে দিল্লির বার্তাও পৌঁছে গিয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক কূটকচালি। এই স্মরণানুষ্ঠান হওয়া উচিত না উচিত নয়? এ কী কেবল হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর ব্যর্থ প্রয়াস নাকি জাতির পক্ষে একান্ত জরুরি? বাংলাস্ফিয়ারের মতামত কী?
লজ্জা নয়, দায়িত্ববোধ
আমরা স্পষ্ট, উচ্চকিতভাবে এই উদযাপনের পক্ষে। কেন? ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়কে মনে রাখা—লজ্জার নয়, দায়িত্ববোধের প্রতীক।
—দুনিয়ায় হেন কোনও দেশ নেই যার ইতিহাস আলোছায়াময় নয়। আলোটা জ্বলুক আর অন্ধকারটুকু কার্পেটের তলায় চাপা পড়ে থাকুক, এমন সুবিধাবাদী নীতি আদতে একটি পরিণত, স্বাস্থ্যবান, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে আগ্রহী সমাজের পক্ষে একান্ত ক্ষতিকর। কেন?
A nation which forgets its past in condemned to
কীভাবে পালিত হওয়া উচিত এমন স্পর্শকাতর অঘটনের স্মরণানুষ্ঠান?
সত্যকে সত্যের স্বীকৃতি দিয়ে। ইতিহাসকে বলতে হবে পক্ষপাতহীন হয়ে, দলীয় রাজনৈতিক বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে। নিশ্চিত, সন্দেহাতীত তথ্য ও প্রমানের ভিত্তিতে যার আবশ্যিক পূর্বশর্ত হোল মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দান।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন, ভারতের জরুরি অবস্থা, আমেরিকার দাসপ্রথা, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য কিংবা ইউরোপে হলোকাস্ট—এই ঘটনাগুলোর সত্য চাপা দিলে সমাজের নৈতিক ভিত্তি ।
প্রতীক নয়, প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতি
মনে রাখার দায় শুধু ভাস্কর্য বা ভাষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষিত হতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন
- পাঠ্যক্রমে সংশোধন
- আর্কাইভ, গ্রন্থাগার ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠা
- জাতীয় স্মরণদিবস, তবে তা যেন কেবল আনুষ্ঠানিকতা না হয়
📌 উদাহরণ:
- জার্মানিতে হলোকাস্ট পাঠ বাধ্যতামূলক এবং স্মৃতিস্তম্ভ সর্বত্র।
- দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
- চিলি ও আর্জেন্টিনায় সেনাশাসনের শিকারদের জন্য রাষ্ট্রীয় স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে।
ভিন্নমত, প্রতিচিন্তা ও জবাবদিহির স্থান নিশ্চিত করা
অতীতের অন্ধকার সময়কে স্মরণ মানে সেই সাহসী কণ্ঠগুলোকে সম্মান করা যারা প্রতিবাদ করেছিলেন—অনেক সময় ব্যক্তিগত মূল্য দিয়ে।
একটি পরিণত গণতন্ত্র অস্বস্তিকর সত্যের আলোচনার জায়গা করে দেয়, তা মুছে ফেলে না।
ইতিহাসকে সংগ্রাম হিসেবে শেখানোর প্রয়াস, পৌরাণিক কাহিনীর মৌড়কে নয়।
ইতিহাস কেবল গৌরবের গাথা নয়; সংগ্রাম, বৈপরীত্য, অবিচার ও মুক্তির গল্প।
দেশাত্মবোধক ভক্তিগাথা নয় চাই বস্তুনিষ্ঠ, নির্মোহ বিশ্লেষণ।
ভুক্তভোগীদের সম্মান দিন, নির্যাতকদের গৌরবান্বিত করবেন না
রাষ্ট্র কখনও সেই নিপীড়কদের গৌরব গাথা গাইতে পারে না যারা:
- দমন-পীড়ন চালিয়েছে,
- মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল
শিক্ষাতে হোল, অতঃপর?
শিক্ষা অর্থহীন যদি না থাকে
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
- স্বাধীন গণমাধ্যম
- নাগরিক অধিকার
- জরুরি ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা
- নজরদারি ও পুলিশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইনি সুরক্ষা
🧠 স্মৃতি হোক সতর্ক প্রহরী, কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়।
স্মৃতি রোমন্থন হোক বহুস্বরে
রাষ্ট্র একাই ইতিহাসের কথা বলবে না—প্রান্তের কণ্ঠগুলোও বলতে দিন।
দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, রাজনৈতিক বন্দি, নারীবাদী, ভিন্নমতাবলম্বী—তাঁদের কাহিনিই গড়ে তোলে একটি জাতির পূর্ণ স্মৃতি।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শেখান:
- গণতন্ত্র একদিন ভেঙে পড়েছিল
- সেন্সরশিপ বাস্তব ছিল
- ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছিল
- সাধারণ মানুষ তার মূল্য দিয়েছে
উপসংহার
হলে ভালো হয় কিন্তু হবেনা
আমাদের সমাজ-রাজনীতি এখনও অপরিণত
হবে তার মানে কাজিয়া। পারস্পরিক দোষারোপ।