Home বিশেষ প্রবন্ধ শুধু মিছে কথা, ছলনা

শুধু মিছে কথা, ছলনা

সুদীপ্ত ভট্টাচার্য

by Sudipta Bhattacharya
0 comments 38 views

(ইজরায়েল যখনই কোনও গন্ডগোলে জড়িয়ে যায় একটি লব্জ ফিরে ফিরে জনতার সারণিতে ভেসে ওঠে। অ‍্যান্টি-সেমিটিজম। আমরাও শব্দটি প্রয়োগ করি অনেক সময় অর্থ না বুঝেই।লেখক এই নিবন্ধে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ভাষায় রহস‍্যের অন্তর্জাল ভেদ করেছেন)।

একজন ইজরায়েলি নিজের দেশ বলতে কী বোঝেন?
যা বোঝেন,একজন ভারতীয়র পক্ষে তা বুঝতে পারাটা বেশ চাপের ব‍্যপার। কেন? ভারতীয় কী বোকা?
আদপেই নয়।
বিগত পাঁচ হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জনজাতি ভারতবর্ষে এসে তাদের নিজস্বতাকে ভারতীয় সাংস্কৃতির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে নিজেরাও ভারতীয় হয়ে উঠেছে । রবি ঠাকুর যাকে বলেছেন, ‘শক, হুনদল, পাঠান, মোগল এক দেহে হোল লীন।’ অর্থাৎ দেশ হিসাবে ভারত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিবর্তিত হয়েছে; হঠাৎ করে একদিন সকালে উঠে একটি ভৌগোলিক অঞ্চলকে ভারত বলে ডাকা শুরু হয়নি ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে হুড়মুড় করে যে কয়টি দেশ ভূমিষ্ঠ হয় তার মধ‍্যে ইজরায়েল অন‍্যতম। সেই সৃষ্টির মধ‍্যেই অনাসৃষ্টির বীজ রোপিত হয়েছিল কেননা ফিলিস্তিনী ভূখন্ডের একটি টুকরো কেটে তার নাম দেওয়া হোল ইজরায়েল। সমস্যার সূত্রপাত এখানেই । সেটা কী?
লঘু ছন্দে বলতে হলে তেল আর জলে মিশ খাওয়ার। অন‍্যের জমি-জিরেত জবরদখলের চেয়েও বড় সমস‍্যা হয়ে দাঁড়াল সংস্কৃতির সঙ্ঘাত। ইজরায়েলের জন্মের পরে প্রথম হোমল‍্যান্ডের আকর্ষণে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে, বিশেষতঃ ইউরোপ থেকে ইহুদিরা এখানে যাদের সঙ্গে থাকতে এলেন, তাঁরা ফিলিস্তিনি, মূলতঃ আরবি মুসলমান ! অর্থাৎ না ধর্মে না সংস্কৃতিতে, কোথাও অধিবাসীদের সঙ্গে অভিবাসীদের কোনও মিল খুঁজে পাওয়া গেলনা।
খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে আসিরীয় ও ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের আগ্রাসনের কারণে ইহুদীরা যেমন একাধিকবার স্বভূমিচ্যুত হয়েছিল তেমনি আবার, আকামেনিদ সাম্রাজ্যের পারসিক সম্রাট সাইরাসের বোন‍্যতায় স্বভূমে প্রত্যাবর্তনও করেছিল । এই যাওয়া-আসার পর্ব সমাপ্ত হয় রোমান শাসনকালে। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রীস্ট পরবর্তী ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে। রোমানরা ঘেঁটি ধরে ইহুদিদের সেই যে তাড়িয়ে দিল তারপরে আর তাঁরা ঘরমুখো হতেই পারেননি।অবশেষে ১৯৪৮ সনে স্বাধীন ইজরায়েল দেশ স্থাপিত হওয়ার পরে ইহুদিরা আবার তাদের প্রাচীন ভূমিতে বসবাস করতে ফিরে আসে ।
তাদের এই প্রত্যাবর্তনের পিছনে যে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে শুরু হওয়া যায়োনিক আন্দোলন বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল এ সবই ইতিহাস জিজ্ঞাসু মানুষের জানা।এটাও মনে রাখা দরকার যে যায়োনিজমকে সেসময়ে যারা সমর্থন করেছিল ,তাদের মধ্যে কেবল ই নয়, অনেক ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ, বিশেষত খ্রিস্টানরাও ছিল ।
প্রশ্নটা হলো মাঝের এই হাজার দেড়েক বছরে ইহুদিদের জীবনে কী ঘটেছিল? না আমি তাদের ওপর ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের অত‍্যাচারের কথা বলছিনা। , সেগুলো তো সর্বজনবিদিত প্রমাণিত সত্য ।আমি এখানে তাদের জীবন-চর্যা তাদের ভাষা, আদব কায়দা, আচার, ব্যবহার ইত‍্যাদির প্রসঙ্গে আসতে চাই । রোমান আমলে ঈহুদিরা স্বভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে ইউরোপ এবং এশিয়ারন নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, যার একটা বড় অংশ পরবর্তীকালে স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ইত্যাদি দেশে চলে গিয়ে বংশানুক্রমিক ভাবে বসবাস করতে শুরু করে । ইহুদী ধর্মাবলম্বী হলেও প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ইউরোপীয়দের সঙ্গে তাদের বৈবাহিক মিশ্রন শুরু হয়, এবং জিনগত বিচারে তারা অর্ধ-ইহুদী, সিকিভাগ ইহুদি হয়ে পড়তে থাকে । ভাষার দিক দিয়ে স্থানীয় দেশজ ভাষাই ক্রমশ তাদের মাতৃভাষা হয়ে যায় । অর্থাৎ বহু শতাব্দী বসবাসের পর তারা তাদের উদ্বাস্তু বা অভিবাসীর তকমা ঝেড়ে ফেলে জার্মান-ইহুদী, পোলিশ-ইহুদী, রুশ-ইহুদী হিসাবে পরিচিত হতে শুরু করে । ইউরোপের খ্রিষ্টানদের কাছে তারা কতটা গ্রহণযোগ্য ছিলো বা আদৌ ছিলো কিনা, সেগুলো অন্য বিষয়, কিন্তু ধর্মের বাইরে তারা যে ইউরোপীয় সমাজের অবিচ্ছেদ‍্য অংশ হয়ে উঠেছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই ।
এই প্রসঙ্গে আস্কেনসি ইহুদিদের কথা চলে আসে । ২০০০ সালের হিসেব মতো তৎকালীন বিশ্বের ইহুদিদের ৬৫% থেকে ৭০% আস্কেনসি ইহুদী । আস্কেনসি ইহুদীদের পূর্বপুরুষদের /সন্ধান করতে হলে আমাদের যেতে হবে মধ্য-দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপের দিকে ।তাদের জিনের গঠনের সঙ্গে সামগ্রিকভাবে ইহুদী জিনের সাদৃশ্য থাকলেও বিশেষতঃ তাদের মায়ের দিক থেকে পাওয়া জিনের সঙ্গে ইউরোপীয় জিনের জিনের মিল অনেকখানি।
এবার ভাষার প্রসঙ্গে আসা যাক। একথা মনে রাখা দরকার যে হিব্রুভাষার ব্যবহার খ্রিস্টের জন্মের ঢের আগেই ইহুদিদের মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আর তার জায়গা নিয়েছিল আরামাইক । হিব্রু সীমাবদ্ধ ছিল ধর্মের বইয়ে। মধ্যেই ফলতঃ, ঊনবিংশ বা বিংশ শতকের ইউরোপীয় ইহুদিদের মধ্যেও ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে হিব্রুর বিশেষপ্রচলন ছিল না। যদিও জায়োনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে হিব্রুকেই মূল কথ্য ভাষা হিসাবে চালু করবার প্রচেষ্টাও শুরু হয়, যেকারণে ইজরায়েল পুনঃ প্রতিষ্ঠার পর হিব্রুই সেদেশের কথোপকথনের মাধ‍্যম হয়ে ওঠে । ঠিক যেমন ভাবে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাঞ্জাবী , সিন্ধী, ইত্যাদি ভাষার বদলে উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসাবে চালু করা হয়, যদিও সেই সময় ওই সব অঞ্চলের মূল কথ্য ভাষা মোটেই উর্দু ছিল না ।
এবার ভেবে দেখা যাক সেমিটিক শব্দটির অর্থ কি? শব্দটি আদতে একটিভাষা-গোষ্ঠীকে বোঝায় যার মধ্যে আরবী , হিব্রু, আরামাইক, এমনকিঅতীত কালের ফিনিশীয় , আক্কাদীয় সবই পড়ে । এখানে এটাও মনেরাখা দরকার যে আরবরাও ঠিক কোনো একটি বিশেষ জাতি নয়, বরংএকটি মিশ্র জাতি, যাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের অনেকখানিইএক, যা তাদের জাতি হিসাবে ঐক্যবদ্ধ করেছে ।
অতএব সব মিলিয়ে বিষয়টা যা দাঁড়ালো তা হলো একটি জনজাতির অর্ধেকের বেশি মানুষ জিনগত ভাবে যতখানি ইহুদী প্রায় ততখানি ইউরোপ; এক-দেড়শো বছর আগে অব্দি তারা ইউরোপীয় ভাষাতে অধিক সচ্ছন্দ| ফলতঃ, তারা যদি আজকেআরব দুনিয়ার একাধিক দেশের বিরুদ্ধে আন্টি-সেমিটিসম এর কারণদেখিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে তবে তা আশ্চর্যের কারণ হয় বৈকি! আশ্চর্যলাগে কার রূপপুরে যাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ ঘোষণা, তারা তো চিরকালীন সেমিটিক এমনকি ইহুদী জনজাতির অর্ধেকের বেশি মানুষের চেয়ে জিনগত এবং ভাষাগত ভাবে অনেক বেশি ।
অতয়েব ধৰ্ম এবং জাতিগত বিভেদের কারণ দেখিয়ে গতকয়েক দশক ধরে ইসরায়েলের এই যুদ্ধ ঘোষণা হাস‍্যকর।এই যুদ্ধাদির পেছনে বিশ্ব-রাজনৈতিক স্বার্থ এতো বেশি প্রকট যে ওই অ‍্যান্টি-সেমিটিজমের এর কারণ দর্শানোটা আজকাল শাক দিয়ে মাছঢাকার মতোই বোকা বোকা মনে হয় ।

(সুদীপ্ত একজন কৃতী রাশি-বিজ্ঞানী। কিলো কিলো বছর প্রবাসে থাকলেও আনখশির এক গর্বিত বাঙালি। ইউরোপের বহু ঘাটে নৌকো ভেড়ানোর পরে এখন বেশ কিছুদিন তিনি থিতু আছেন আমেরিকায়-সম্পাদক)

Leave a Comment

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles

All Right Reserved.