ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। বহু দশক ধরে ইজরায়েল ও ইরান যে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তা অবশেষে শুরু হয়ে গিয়েছে। তা একযোগে কতটা ভীতিকর ও বিস্ময়কর হতে পারে, নিশ্চিত দূরত্বে বসে থেকে আমরাও তা দেখে শিউরে উঠছি।টেলিভিশনের পর্দায় এ দৃশ্য বড় মনোহর মনে হয়, বিভ্রম হয়, রাতের নিকশ অন্ধকারে হঠাৎ উজ্জ্বল একগুচ্ছ আকাশ-প্রদীপ দেওয়ালির রাতে হাঊইয়ের মতো মাটিতে ঝরে ঝরে পড়ছে। সকাল হলে বুঝতে পারা যায় সন্ধ্যাতারার কী ভয়ঙ্কর, ভয়াবহ প্রভাব, বড় বড় দালান হয় ধ্বংসস্তুপে পরিণত নতুবা একটি গোটা জনপদই ধ্বস্ত হয়ে গিয়ে ভূমিশয্যা নিয়েছে। কখনও সাইরেনের একটানা গা-গোলানো শব্দ, কখনও দাউদাউ আগুনের লেলিহান শিখা-প্রতিবারই আমাদের বিপন্ন বিস্ময়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, ভিডিওতে ওয়ার গেম দেখছি না বাস্তবেই এমনটি হচ্ছে, ভাবতে ভাবতে ধাঁধা লাগে! সত্য-অসত্য, মমতা-নির্মমতা, সভ্যতা-বর্বরতার মধ্যে ভেদরেখাগুলি সহসা মুছে যায়, কোনটার কোথায় শুরু, শেষই বা কোথায়, বোঝার ব্যর্থ চেষ্টায় মনটা বিবশ হয়ে যায়, এক নির্জীব অসারতা আর অসহায়তা মনুষ্য-অস্তিত্বের ঘেঁটি নাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়।
ইজরায়েলের যুদ্ধবাজ কর্মকর্তারা হুঙ্কার দিচ্ছেন আর মাত্র সপ্তাহ দুয়েক সময়ের মধ্যেই ইরানের পরমাণু শক্তিধর হওয়ার এতদিনের লালিত স্বপ্ন তাঁরা দূরাগত ভবিষ্যতের গর্ভে চালান করে দিতে পারবেন, উগ্র মোল্লাতন্ত্রের বিষ দাঁত-নখ সব উপড়ে ফেলা যাবে,পশ্চিম এশিয়ার সদা-উত্তপ্ত ভূখন্ডে নেমে আসবে দীর্ঘকালীন শান্তি। কে বলতে পারে ইরানবাসীর কাছে আজ যা অভিশাপ বলে মনে হচ্ছে আগামীকাল ইজরায়েলি হানার সৌজন্যে তা কোনও এক সকালে আল্লাহর আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেবেনা? তেহরানের দিগন্ত লালে লাল করে দিয়ে উঠবেনা মোল্লাতন্ত্র-মুক্ত পারস্যের নয়া মুক্তি-সূর্য?
বলা যেতেই পারে আকাশ-কুসুম রচনার প্রহর এটা নয়, দুরুদুরু বুকে একটানা প্রার্থনার সময়।এই দমবন্ধ করা বারুদের গন্ধের মধ্যে জল্পনার কোনও অবকাশই নেই।সামান্য চারটি দিন অতিক্রান্ত হতে না হতেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে হামাস অথবা হেজবোল্লার মতো এ লড়াই আদপে অসম লড়াই নয়, রীতিমতো সেয়ানে-সেয়ানে কোলাকুলি।এ লড়াই যতটা না ক্ষেপণাস্ত্রের খেলা তার চেয়ে অনেক বড় স্নায়ুর খেলা।লৌহ-কঠিন মানসিক শক্তি, ধৈর্য নিয়ে কে কতক্ষণ যুদ্ধের ঘূর্ণি উইকেটে টিকে থাকতে পারবে অনেকাংশে তার ওপরেই নির্ভর করবে শেষ হাসি হাসবে কোন পক্ষ।
তবে আমেরিকা যা পারে, মুৎসুদ্দি ইজরায়েল এখনও তার সবটা পারেনা। তার সামরিক ফুটুনি মেড়ার মতো খুঁটির জোরে। তাই শেষ পর্যন্ত ইরানে দুর্গম পাহাড়ের নীচে মাটির গভীরে থাকা পরমাণু কেন্দ্রে চূড়ান্ত আঘাত হানতে, আমেরিকার সহায়তা অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারে। এখন ইজরায়েলের লক্ষ্য গপ্পের ফানুস উড়িয়ে রাখা, এমন একটা হাওয়া তৈরি করে রাখা যাতে বাকি বিশ্ব মনে করে ইরানকে সবক শেখানোও নেতানিয়াহুর বাঁয়ে হাত কা খেল, না পারলে পাগলা দাশু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পতো রক্ষাকর্তা হয়ে আছেনই।। আবার উল্টোটা হওয়াও অসম্ভব নয়। আমেরিকা কিছুতেই চাইবেনা এই যুদ্ধ যদি দীর্ঘমেয়াদি হোক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাক, ইরাণের স্বপ্ন চূরচূর করে দেওয়া সম্ভব হোলনা সেক্ষেত্রে যুদ্ধের ঘোষিত উদ্দেশ্য অপূর্ণ রেখেই রণে ভঙ্গ দিতে হতে পারে তেল আভিভকে।
প্রথম ধাক্কা
১৩ই জুন ভোরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইজরায়েল শত শত বিমান হামলা চালিয়েছে। পাল্টা জবাবে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়েছে, যদিও বেশিরভাগই আয়রণ ডোমে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ডোমকে ফাঁকি দিয়ে সামান্য কয়েকটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইজরায়েলে ইতি-উতি কয়েকটি জায়গায় ধ্বংসলীলা চালালেও, ইরানের ক্ষতির সঙ্গে তার কোনও তুলনাই চলেনা।
ইজরায়েলের ঘোষিত অবস্থান ঘরের পাশে ইরান পরমানু শক্তিধর হওয়া মানে তাদের অস্তিত্বের সঙ্কট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বহু ক্লেশ আর অপমান সহ্য করে তিল তিল করে এক খন্ড মরুভূমিতে তারা যে তাদের মতো একটি স্বগৃহ তৈরি করেছেন তার কোনও অস্তিত্বই থাকবেনা। এমন ভূতগ্রস্ত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্যে বুক বাজানো কোনও দেশের সরকারি নীতি হতে পারেনা, বিশেষ করে ইজরায়েলের, যারা কথায় কথায় হুমকি দিয়ে বলে পশ্চিম এশিয়ার প্রতিটি কোনা সর্বক্ষণ তাদের নজরবন্দী হয়ে থাকে। তবে এই প্রশ্নটি এমন আলোচনায় আপাতত অপ্রাসঙ্গিক।
চার রাতের যুদ্ধে ইজরায়েল সীমিত সাফল্য লাভ করেছে, আপাতত এর বেশি কিছু বলা যাচ্ছেনা। ইরানের পরমানু পরীক্ষার শক্তি খানিকটা খর্ব হলেও হতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। তাদের চোখ-ধাঁধানো সমরাস্ত্রের ঝোলায় অনেক কিছু আছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত।
ইতিহাসের প্রতিধ্বনি
এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রয়েছে এক প্রাচীন স্মৃতি — ইরাকের সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধের ইতিহাস। ১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়, ইরাক তেহরান সহ বিভিন্ন শহরে স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে আঘাত হানে। নাদান ইরান তখন তা সামাল দিতে পারেনি, আয়াতোল্লাকে চোখের জলে যুদ্ধবিরতি করতে হয়েছিল। এমন বেইজ্জতি ইরান ভুলতে পারেনি, তারপর থেকে ধীরে ধীরে সে তার নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার গড়ে তোলে, যার পেছনে ছিল লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়ার প্রযুক্তি। আজ তারা প্রতি বছরহাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে পারে হাসতে হাসতে।
অন্যদিকে, ইজরায়েল তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করে ভিন্ন পথে। আমেরিকার সাহায্য নিয়ে আয়রন ডোম, অ্যারো, ডেভিড’স স্লিং-এ বিনিয়োগ করে এবং শয়ে শয়ে মার্কিন যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করে সেগুলোকে লং-রেঞ্জ অভিযানের উপযোগী করে তোলে। এমনকি প্রতিটি নতুন বাড়িতে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কার রাখা এখন বাধ্যতামূলক।
যুদ্ধ আর আত্মরক্ষায় ইজরায়েল এখন জলের মতো টাকা খরচ করে চলেছে। ২০২৩ এর অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত যুদ্ধ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৮৫ বিলিয়ন ডলার
শুধু ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধেই প্রতিদিন খরচ হচ্ছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার।
কেন এমন বিপুল অর্থব্যয়? ইহুদিরা মনে করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যদি কর্য মিটিয়ে যেতে হয় তাও সই, কিন্তু দেশের অস্তিত্ব সুরক্ষিত রাখতেই হবে।
চূড়ান্ত লক্ষ্য কি?
ইজরায়েল আশা করছে, এই চাপ ইরান বেশিদিন সইতে পারবেনা, তারা বাধ্য হবে ট্রাম্পের শর্তে আলোচনার টেবিলে এসে পরমানু শক্তিধর হওয়ার স্বপ্ন কুলুঙ্গিতে তুলে রাখতে। বোনাস হিসেবে অতিরিক্ত পাওনা হতে পারে মোল্লাতন্ত্রের নির্মম, নীরন্ধ্র পতন।
আশায় বাঁচে চাষা। নেতানিয়াহুই বা স্বপ্ন দেখবেননা কেন?