লাঙ্গল যার জমি তার। বুদ্ধি যার বলও তার। এ পর্যন্ত আমরা সবাই জানি। শাস্ত্রেই বলে দেওয়া আছে।
কিন্তু মহামতি হওয়ার জন্য বুদ্ধি থাকাটাই কী যথেষ্ট। না। তদতিরিক্ত কিছু লাগে। সেটা কী?
আছে, আছে, জানতি পারনা।
ঘোড়ার ডিম, আছেটা কী?
চোখ বুঁজে এক রুশ মহামতির কথা ভাবুন। ভ্লাদিমির জোসেফ স্তালিন। নাম শোনেননি?
কুছ পরোয়া নেই, সোজা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএম আপিসে চলে যান। দুনিয়ার বাকি সবাই ভুলে গেলেও ওঁরা এখনও স্তালিনের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন। আপনি গিয়ে খোঁজ খবর করলে প্রথম চোটে ওঁরা ভাবতে পারেন আপনি ভিন গ্রহের বাসিন্দা, তারপর সম্বিত ফিরলে দেখবেন আপনাকে ওঁরা বেশ আদর আপ্যায়নই করছেন। মেহনতি জনতার বিপ্লব সাঙ্গ হয়ে গিয়েছে সেই ২০১১ সালে। তারপর থেকে ওরা বেকার। মানে কাঠ বেকার। লেবু দেওয়া, বিনা চিনি লাল চা গেলা ছাড়া ওদের হাতে এখন বিশেষ কাজ নেই। ওঁরা এখন মহাশূন্যবাসী, জীবন–জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত। মহাপ্রস্থানের দিনক্ষণ কবে আসে কেবল সেই চিন্তা নিয়েই তাদের যাবতীয় কর্মকান্ড। রাজ্য কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি, পলিটিব্যুরো, সর্বত্র সব স্তরে এখন যাবতীয় আলোচনা তাই একটি প্রশ্নকে ঘিরেই। শূন্য থেকে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যেতে ডায়ানোসরদের কত সময় লেগেছিল?
মস্করা থাক। স্তালিন কিন্তু এমনি এমনি মহামতি হয়ে উঠতে পারেননি। তাহলে কেমতি তিনি মহামতি হলেন? তাঁর পাথর–কঠিন ঘটে চারশ চল্লিশ ভোল্টের বুদ্ধির তরঙ্গ অহর্নিশ খেলা করত বলে? সে তো বটেই। এই মামুলি জবাবের জন্য কোনও পুরস্কার দিতে পারলামনা। দুঃখিত।
তাহলে? মগজাস্ত্রে একটু শান দিন, বুঝতে পারবেন বুদ্ধিমান হলেই মহান হওয়া যায়না। তদতিরিক্ত একটা এক্স ফ্যাক্টর লাগে। সেটা কী?
সুখে–দুঃখে বিগতস্পৃহতা, চরম সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েও চূড়ান্ত ভাবলেশহীন আচরণ। যে সে রকম ভাবলেশহীনতা নয় একেবারে অলৌকিক, অবিশ্বাস্য ভাবলেশহীন হয়ে থাকার ক্ষমতা। এমন প্যাকেজ নিয়ে দুনিয়ায় বেশি মানুষ জন্মায়না। স্তালিন জন্মেছিলেন।
বিশ্বাস না হলে মন দিয়ে একটি ঘটনার কথা শুনুন। আনখশির সত্য ঘটনা, কমিউনিস্টি অতিকথনের লেশমাত্র নেই।
১৯২৭ সাল।ট্রটস্কিকে বলশেভিক পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, সময়টা অত্যন্ত উত্তপ্ত। এমন সময়ে, লাল ফৌজের এক দশাসই ক্যাভেলরি কমান্ডার স্তালিনের মুখোমুখি হয়ে তাঁর দুটো কানই কেটে নেওয়ার হুমকি দিলেন। খাপ থেকে তরোয়াল বের করে সিঁড়িতে এমনভাবে পথ আগলে দাঁড়ালেন, মনে হল বোধহয় সত্যিই স্তালিনের কান যুগল এবার মাটিতে গড়াগড়ি খাবে।
আর স্তালিন?
কিছুই বললেননা। এক্কেবারে স্পিকটি নট।
মূর্তির মতো অবিচল দাঁড়িয়ে থাকলেন।
বিচলিত বোধ করা দূরে থাকুক, আহাম্মক ফৌজির এমন অপ্রত্যাশিত, উদ্ধত আচরণ তাঁকে স্পর্শ করেছে বলেও মনে হোলনা।
অথচ, চারপাশে সবাই বুঝতে পারছিলেন স্তালিন ভিতরে ভিতরে কতটা অগ্নিশর্মা হয়ে গিয়েছেন। লোকে যাই ভাবুক স্তালিন জবাব দিলেন শুধুমাত্র অবজ্ঞায়। সম্রাট– সুলভ ছিল সেই অবজ্ঞার বিভঙ্গ।
এটা কি সাধারণ আচরণ?
না, প্রায় অলৌকিক।
এবার এই কাহিনী থেকে কোনও বৃহত্তর সত্যের সন্ধান পাচ্ছেন কী?
ভাবুন, ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিশ করুন, আলবাত পেয়ে যাবেন।
সত্যটা সংক্ষেপে এই রকম। যদি আপনার জীবনে সত্যিই একটি নির্দিষ্ট গন্তব্য থেকে থাকে, তবে পথের প্রতিটি টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে তার উপরে যুদ্ধ করতে গেলে আপনি আর এগোতেই পারবেন না।
কারণ টিলা তো অসংখ্য—প্রতিটি টিলার উপরে যদি আপনি আবেগে বা রাগে লড়াই শুরু করেন, তবে শেষ পর্যন্ত আপনি গন্তব্য হারিয়ে ফেলবেনই ফেলবেন।
আর যারা প্রতিটি লড়াইকে মানসিক অথবা নৈতিক লড়াই হিসেবে নেয়, তারা আসলে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া ঘুরে বেড়ানো ভিড় মাত্র। আর কিচ্ছুটি নয়।
তাদের “নীতির লড়াই” আসলে একরকম প্ররোচনার ফাঁদ। পা দিয়েছ কী মরেছ!
স্তালিন জানতেন, সেই মুহূর্তে যদি তিনি প্রতিক্রিয়া দেখান, তবে ওই বেয়াদপ কমান্ডারই জয়ী হয়ে যাবে। তিনি হারবেন।
কারণ তিনি তখনও সর্বশক্তিমান নন।
তাঁর নিজের পার্টি তাঁকে সন্দেহ করে।
তাঁর শত্রু ট্রটস্কির জনপ্রিয়তা অনেক বেশি।
আর সামরিক বাহিনীতেও স্তালিনের জনপ্রিয়তা খুবই সীমিত।
তাঁর পক্ষে তখন কোনো নাটকীয় প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব নয়।
এমনকি ট্রটস্কিকে হত্যা করাও তখন আত্মঘাতী হত।
কারণ সেটা করলেই ট্রটস্কিবাদীরা স্তালিনকে খুন করতে উদ্যত হোত। হয়ত সফলও হতে পারত।
সুতরাং, কী করতে হত?
- শান্ত থাকতে হত।
- প্রতিটি উসকানিকে পাত্তা না দিয়ে কৌশলে পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে হত।
- অমানবিক ভাবলেশহীনতা ছাড়া অসাধ্য সাধন হোতনা!
চারপাশে তারিয়ে দেখুন।অসংখ্য মানুষ সুযোগসন্ধানী কিন্তু তাদের প্রায় কেউই সামান্য প্ররোচনার মুখেও নিজেকে স্থির রাখতে পারে না।
এই কারণে, স্তালিনের ধৈর্য ও নীরবতা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল।
শিম্পাঞ্জি ও স্তালিনের মধ্যে তফাত তাহলে কোথায়?
যদি আপনি লক্ষ্য করেন—
বেশিরভাগ মানুষ “শিম্প মডেলে” চলে।
- একটু অপমান—উল্টে গালি।
- একটু খোঁচা—বিস্ফোরণ।
- একটু উস্কানি—উন্মাদ প্রতিক্রিয়া।
বিশেষ করে ভিড়ের মধ্যে থাকলে এই প্রতিক্রিয়া সর্বনাশা আকার ধারণ করে।
কারণ ভিড় হল আবেগের সমষ্টি, পরিকল্পনার নয়।
তারাকোনওগন্তব্যেযায়না।তারাশুধুলড়াইকরতেইব্যস্তথাকে।
স্তালিন কী করলেন?
- প্রতিক্রিয়াহীন রইলেন।
- কাউকে ভয় দেখালেন না।
- কাউকে অপমান করলেন না।
- কিছুই বললেন না।
এতে অন্যরা ভাবল—“স্তালিন কিছুই না। ও তো নিরীহ। ওর কোনো উচ্চাশা নেই।”
এবং এখানেই স্তালিন জিতে গেলেন।
কারণ সবাই যখন চিৎকার করছে, স্তালিন তখন চুপচাপ পেছন থেকে জমি দখল করে নিচ্ছেন।
সর্বশক্তিমান হওয়ার পথে এমন চুপচাপই হাঁটতে হয়।
স্তালিন জানতেন:
- এখন প্রতিক্রিয়া দিলে, ভবিষ্যত অন্ধকার।
- এখন শান্ত থাকলে, ভবিষ্যত আলোকোজ্জ্বল।
- উস্কানির ফাঁদ এড়িয়ে গিয়ে উদ্দেশ্যকে অগ্রাধিকার দিলে,
ধীরে ধীরে একদিন আপনিই হবেন সব শক্তির সমাহার। জেনারালাসিমো। মহামতি।
মনুষ্য সমাজে এই গুনটি বড়ই দুর্লভ। প্রায় অস্তিত্বহীন।
কারণ আমারা সবাই অস্তিত্বগতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল।
বেশিরভাগ আটপৌরে মানুষ অনুভূতির দাসানুদাস। এতটাই ভিড়ের চাপে কাবু, যে প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে স্থির থাকা তাঁদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
আর যে মানুষ এই অসম্ভব কাজটি করে ফেলতে পারে—
তিনিই একদিন ইতিহাসের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন।
স্তালিন তাই শুধু ক্ষমতা দখল করেননি।
তিনি সেটি করেছিলেন এমন এক মানসিক কৌশল ও আত্মসংযমের মাধ্যমে যা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ কল্পনাও করতে পারেনা।
এবার খোলসা হোল বিষয়টা?